সুনামগঞ্জের দিরাই পৌরসভার  হারনপুর রোডের একটি ভাড়া বাসায় বসবাস করে এক অসাধারণ মেধাবী কিশোরী—শ্রেয়া দাস অর্পি (১৬)। অপ্রতিরোধ্য মেধা আর অদম্য মানসিকতায় দারিদ্র্যকে জয় করে এবার ২০২৫ সালের এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগে গোল্ডেন এ+ (জিপিএ ৫) অর্জন করেছে এই বিস্ময়বালিকা।

শ্রেয়া দিরাই সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের নিয়মিত ছাত্রী। তার সাফল্যে মুগ্ধ স্কুলের শিক্ষকরা বলেন, শ্রেয়া শুধু মেধাবী ছাত্রীই নয়, একজন অলরাউন্ডার। সে গান, নৃত্য, চিত্রাঙ্কন, আবৃত্তি, এমনকি মেধা পরীক্ষায়ও একাধিক পুরস্কার পেয়েছে। বাংলাদেশ বেতার সিলেট কেন্দ্রের নিয়মিত শিল্পী শ্রেয়া রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি গাইতে পারে দারুণ পারদর্শিতায়।

তবে এই অর্জনের পেছনে আছে এক করুণ বাস্তবতা। ৫ম শ্রেণী পাস শ্রেয়ার বাবা রূপক দাস মধ্যবাজারে একটি ফলের দোকানে স্বল্প বেতনের চাকুরিজীবী। চার হাজার টাকা ঘরভাড়া, সঙ্গে সংসারের খরচ সামলাতে নাভিশ্বাস উঠছে পরিবারটির। শ্রেয়ার মা রিপা রায় জানান, “আমরা খেয়ে না খেয়ে হলেও মেয়েদের পড়ালেখা বন্ধ রাখিনি। শ্রেয়ার এই সাফল্য আমাদের সকল কষ্টকে সার্থক করেছে।”

শ্রেয়ার ছোট বোন অর্চী দাসও একইভাবে মেধাবী। সে দিরাই মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণির  ছাত্রী। তার রোল নম্বর (২) । তারা দুই বোনই পরিবারে আশার আলো। শ্রেয়ার জীবনে এসেছে একের পর এক মানসিক আঘাত। পরীক্ষার কয়েকদিন আগে স্ট্রোক করে মারা যায় তার মেসো (মাসির স্বামী), পরীক্ষা চলাকালীন খুন হয় কাকাত ভাই প্রান্ত দাস। কিন্তু এসব ঝড় ঠেলে শ্রেয়া পাড়ি দেয় জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষায়।

তাদের গ্রামের বাড়ি তাড়ল ইউনিয়নের বাউসী গ্রামে হলেও পারিবারিক কলহের কারণে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে নেই কোনো যোগাযোগ বা সহায়তা। শ্রেয়ার মা রিপা রায় বলেন, “এই সাফল্যের পেছনে আমাদের শ্রমের সঙ্গে যুক্ত কিছু মহান মানুষের অবদানও রয়েছে। বিশেষ করে স্থানীয় শিক্ষক নিখিল দাস ও কালীপদ দাস  বিনামূল্যে শ্রেয়াকে প্রাইভেট পড়িয়েছেন। তাঁদের এই মানবিক সহায়তা না পেলে এই ফলাফল সম্ভব ছিল না।”

শিক্ষক নিখিল দাস বলেন, “শ্রেয়া আসলে এক অলরাউন্ডার। গান, নাচ, ছবি আঁকা, লেখাপড়া—সব কিছুতেই ওর দক্ষতা। আমি তাকে কোনোদিন টাকার জন্য প্রাইভেট পড়াইনি। ওর চোখে আমি স্বপ্ন দেখেছি।”

দিরাই সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষক রফিকুল ইসলাম  বলেন, “শ্রেয়ার এমন অর্জনে আমরা গর্বিত। এখন তার উচ্চশিক্ষার পথকে সহায়ক করতে হলে প্রশাসন ও সমাজের দায়িত্বশীল মানুষদের এগিয়ে আসা উচিত।”

ভবিষ্যতে বিসিএস ক্যাডার হয়ে দেশের জন্য কিছু করতে চায় শ্রেয়া। সে  বলে, “আমার স্বপ্ন সিলেটে ভালো কলেজে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা করার। কিন্তু বাবার বেতনে আমাদের সংসারই চলে না, পড়াশোনার খরচ চালানো দূরের কথা। দিরাই কলেজে ভালো শিক্ষক নেই, তাই ভালো কলেজে পড়তেই চাই। যদি কেউ আমার পাশে দাঁড়াত, তাহলে আমার স্বপ্ন হয়তো থেমে যেত না।

শ্রেয়ার পিতা রুপক দাস বলেন, আমার মেয়েটা অনেক মেধাবী কিন্তু তাকে আমি প্রয়োজনমত সহযোগিতা করতে পারছিনা। আগে একটা কোম্পানিতে চাকরি করতাম কিন্তু এখন বয়স হয়েছে তাই আগের মত কাজ করতে পারিনা।এখন একটা দোকানে চাকরি করি কিন্তু বেতন তেমন একটা পাইনা। তারপরেও আত্নীয় স্বজনের সহযোগিতা,ঋণ তুলে সন্তানদের ভাল পরিবেশে ভাল করে মানুষ করার চেষ্ঠা চালিয়ে যাচ্ছি।

দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীকে সহায়তার আশ্বাস দিয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার সনজীব সরকার বলেন,শিক্ষা প্রত্যেক শিশুর অধিকার।শ্রেয়াকে এককালীন আর্থিক অনুদান দেওয়ার চেষ্টা করব এবং ভবিষ্যতেও যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে সরকারি ও বেসরকারি সহায়তার সংযোগ ঘটাতে কাজ করব। এমন সম্ভাবনাময় শিক্ষার্থীদের পাশে সমাজ ও রাষ্ট্রের সবারই দাঁড়ানো উচিত।

 

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *