আন্তর্জাতিক ডেস্ক::নানা জল্পনার পর আফগানিস্তান ছেড়েছে মার্কিন সামরিক বাহিনী। এরপরই নিজেদের বিজয়ী ঘোষণা করেছে তালেবান। হয়েছে ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’ লাভের উল্লাসও। যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশটি এখন শাসন করবে তালেবান। কিন্তু খুবই দরিদ্র ও কূটনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন আফগানিস্তানকে শাসন করা সহজ কথা নয়। এই কাজে পাঁচটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে তালেবান।
দীর্ঘ চার দশকের যুদ্ধে অনেকটাই ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত আফগান নাগরিকরা। তারা শান্তি চায়, চায় স্থিতিশীলতা। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা মানবিক সংকট, অর্থনৈতিক সংকট, বেকারত্ব এবং অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হওয়া হাজারও আফগান নাগরিকের সমস্যার সমাধানসহ বহু চ্যালেঞ্জ এখন অপেক্ষা করছে তালেবানের সমানে। এখানে তেমনই পাঁচটি বড় চ্যালেঞ্জ আলোচনা করা হলো-
বিশ্বাসের ঘাটতি
তালেবানের ব্যাপারে আফগান নাগরিকদের মধ্যেই বিশ্বাসের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তালেবান যখন কাবুলের ক্ষমতায় ছিল, তখন গোষ্ঠীটি সারা দেশে কঠোরভাবে ইসলামিক আইন জারি করেছিল।
সেই সময় নারী শিক্ষা নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি জনসমাগম বেশি হয় এমন স্থানে নারীদের উপস্থিতির ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তালেবান। এছাড়া রাজনৈতিকভাবে বিরোধীদের নির্মমভাবে হত্যা এবং হাজারাদের মতো ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর গণহত্যা চালায় গোষ্ঠীটি।
তবে এবার আগের মতো কঠোর না হয়ে উদার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে চলার বার্তা দিয়েছে তালেবান। দিয়েছে নারী শিক্ষা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতিও। এছাড়া কাবুলে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারও করেছে তারা।
তবে তালেবানের এসব কথাবার্তায় আফগানিস্তানের প্রান্তিক এলাকার কিছু মানুষ আশান্বিত হলেও দেশটির বেশিরভাগ নাগরিক মনে করছেন, কথা বা প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি ছড়ানোর চেয়ে কাজে বাস্তবায়ন করাই তালেবানের জন্য বেশি জরুরি। আর তাহলেই কেবল সাধারণ আফগানদের বিশ্বাস অর্জন করতে পারবে তালেবান।
অর্থনৈতিক ও মানবিক বিপর্যয়
বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোর একটি আফগানিস্তান। তবে ২০০১ সালে তালেবান ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে দেশটিতে বিশাল পরিমাণ বিদেশি বিনিয়োগ ও সহায়তা আসতে থাকে। ২০২০ সালে দেশটির মোট জিডিপির ৪০ শতাংশেরও বেশি ছিল বৈদেশিক সহায়তা।
তবে সামরিক শক্তির জোরে ফের কাবুলের ক্ষমতা দখলের পর সেসব সহায়তার বেশিরভাগই এখন স্থগিত হয়ে গেছে। আপাতত স্থগিত করা হলেও সেসব সহায়তা আর কখনও আফগানিস্তানে আসবে কি না সেটিও অনিশ্চিত। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে সংরক্ষিত আফগান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তহবিলও ব্যবহার করার অনুমতি নেই তালেবানের।
আর তাই এই সংকট অচিরেই বিপর্যয়ে রূপ নিতে পারে। কারণ সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন দিতে এবং পানি, বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ খাতের মতো সেবাগুলো চালু রাখতে তালেবানের প্রচুর অর্থ দরকার হবে।
পরিস্থিতি বুঝতে পেরেই আফগানিস্তানে মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। ফলে দেশটিতে জরুরি সহায়তা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন সংস্থাটির মহাসচিব আন্তেনিও গুতেরেস। তিনি বলছেন, অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন আফগান নারী, শিশু ও পুরুষদের আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা প্রয়োজন।
যদিও জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলো বলছে, তালেবানের হাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ রয়েছে এবং দেশটির বাণিজ্য ও এ সংক্রান্ত বন্দরগুলো নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তাদের হাতে সেই অর্থের পরিমাণ আরও বাড়ছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আফগানিস্তান পরিচালনা করতে জাতীয়ভাবে যে পরিমাণ আর্থিক সক্ষমতা প্রয়োজন, সেই তুলনায় তালেবানের হাতে থাকা অর্থের পরিমাণ খুবই সামান্য। ফলে বিদেশি সহায়তা আরও কিছুদিন স্থগিত থাকলে দেশটিতে মানবিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে।
মেধা পাচার
আর্থিক বিপর্যয় ছাড়াও কাবুলের শাসন ক্ষমতায় থেকে তালেবান যে বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে, সেটি হচ্ছে দক্ষ আফগান জনগোষ্ঠীর অভাব। গত মাসের মাঝামাঝি তালেবান কাবুলের দখল নেওয়ার পর আফগান নাগরিকদের মধ্যে দেশ ছাড়ার হিড়িক পড়ে। এসময় যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশের সহায়তায় বিপুল সংখ্যক দক্ষ, অভিজ্ঞ ও মেধাবী আফগান নাগরিক কাবুল ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমান।
দেশ ত্যাগ করে বিদেশে পাড়ি জমানো এসব আফগানদের মধ্যে আমলা, ব্যাংকার, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, অধ্যাপক ছাড়াও রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা হাজারো স্নাতক। দেশত্যাগের এই হিড়িকের একপর্যায়ে অবশ্য এর ফলাফল সম্পর্কে কিছুটা আঁচ করতে পারে তালেবান নেতৃত্ব।
এরপরই দেশত্যাগ না করার জন্য দক্ষ ও অভিজ্ঞ আফগানদের প্রতি আহ্বান জানান তালেবানের মুখপাত্র। তিনি বলেন, চিকিৎসক ও প্রকৌশলীসহ দক্ষ কর্মীদের প্রয়োজন রয়েছে আফগানিস্তানে।
কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতা
১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত প্রথম দফায় কাবুলের ক্ষমতায় থাকার সময় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কার্যত বিচ্ছিন্ন ছিল তালেবান। তবে এবার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে অনেক বেশি মুখিয়ে আছে তারা। যদিও কাবুলের পতনের পর বিশ্বের বেশিরভাগ দেশই আফগানিস্তানে তাদের দূতাবাস বা কূটনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে।
পাকিস্তান, ইরান, রাশিয়া ও চীনের মতো আঞ্চলিক শক্তিগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে তালেবান। এমনকি বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশ কাতারের সঙ্গে তালেবানের যোগাযোগও বেশ ভালো। গত কয়েক বছর ধরে সেখানেই তালেবানের রাজনৈতিক কার্যালয়ের কর্মকাণ্ড চলছে।
কিন্তু কাবুল দখলের পর প্রায় ৩ সপ্তাহ হতে চললেও এখন পর্যন্ত কোনো দেশই তালেবানকে স্বীকৃতি দেয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের ভাষায়, যেকোনো ধরনের স্বীকৃতি তালেবানকে অর্জন করে নিতে হবে। তবে সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কিত সাম্প্রতিক একটি বিবৃতি থেকে তালেবানের নাম বাদ দিয়েছে জাতিসংঘ।
জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস-এর হুমকি মোকাবিলা
তালেবান হয়তো আফগানিস্তানের দখল নিয়েছে, কিন্তু তাতে দেশটিতে আইএস-এর সন্ত্রাসী হামলার হুমকি কমেনি। তালেবানের প্রতিদ্বন্দ্বী এই জঙ্গিগোষ্ঠী ইতোমধ্যে কাবুল বিমানবন্দরে রক্তক্ষয়ী হামলা চালিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সামরিক ও বেসামরিক মানুষদের প্রত্যাহার প্রক্রিয়ার মধ্যেই বিমানবন্দরে চালানো ওই হামলায় দেড় শতাধিক মানুষ নিহত হয়। নিহতদের মধ্যে ১৩ জন মার্কিন সেনাও ছিলেন।তালেবান ও আইএস উভয়ই কট্টরপন্থি গোষ্ঠী। আইএস বলছে, তারা আফগানিস্তানে তাদের যুদ্ধ অব্যাহত রাখবে। এছাড়া তাদের বিবৃতিতে তালেবানকে ‘ধর্মত্যাগী’ বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে তালেবানকে এখন কার্যত উল্টো ভূমিকা পালন করতে হবে। তাদেরকে এখন আফগান জনগণকে এমন সব হামলা থেকে রক্ষা করতে হবে, যে ধরনের হামলা বছরের পর বছর ধরে দেশজুড়ে তারাই চালিয়ে এসেছে।
ডায়ালসিলেট এম/